নাসিরনগর-এর অপূর্ব সৌন্দর্যের প্রতীক মেদিনী হাওড়
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এক প্রাচীন জনপদের নাম নাসিরনগর । এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা । এ উপজেলাতেই অবস্থিত অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত মেদিনী হাওড় । এটি লোকমুখে মেদীর হাওড় নামেই বেশি প্রচলিত ।
নাসিরনগর উপজেলা সদরে অবস্থিত ডাক বাংলো ঘেষে উত্তর এবং পশ্চিম এলাকা বিস্তৃত বিশাল মেদিনী হাওড়। অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী এ হাওড় সহসা মানুষের মন আকৃষ্ট করে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এ হাওড়কে প্রকৃতি ষড়ঋতুতে নানা রূপে বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে দেয় যেন শিল্পীর তুলিতে রঙে রঙে, কখনো সবুজের গালিচা, কখনো কুয়াশার চাদরে আবৃত, তীব্র খরায় খাঁ খাঁ মাঠ, আবার আষাঢ় শ্রাবণের ঢলে বর্ষার বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতে থৈ থৈ জলে টইটুম্বুর ।
বিশাল এই মেদিনী হাওড় অনেক ছোট ছোট হাওড়ের সম্মিলিত রূপ-যেমন বাল্যাজুড়ি, শিংজুড়ি, উত্তর বাল্যা ইত্যাদির মিলিত নাম মেদিনী হাওড় । এই হাওড়ের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দেখা দেয় বর্ষা মৌসুমে । চারদিকে অগাধ জলরাশি । উত্তর ও পশ্চিম দিকের গ্রামগুলো সবুজে সবুজময় । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়-
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী মাখা,
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা ।
সত্যিকার অর্থে মাছমা, গোয়ালনগর, ভিটাডুবি, রামপুর, কৃষ্ণপুর, লাখাই প্রমুখ দূরের গ্রামগুলো মনে হয় জলের উপর ভাসছে । যখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে নীরব নিস্তব্ধ রাত আসে তখন হাওড়ের রূপ অন্যরকম আবেশ তৈরি করে, জলের বুকে আকাশের অসংখ্য তারা মিট মিট জ্বলে তখন লংগন নদী ও হাওড় একাকার হয়ে যায় । শুধু দেখা যায় নিয়ত সংগ্রামী জেলে সম্প্রদায়ের ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে । সারা রাত ধরে জেলেরা মাছ ধরে । কখনো জ্যোৎস্না মাখা রাত এবং পূর্ণিমায় চলে আলো আঁধারী লুকোচুরি । মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের মতো এ যেন জলের দেশ; উঠতে বসতে নৌকা, এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন নৌকা ।
হাওড়ের বুকে পূব আকাশ রাঙ্গিয়ে যখন সূর্য উকি দেয় তখন জীবনের সাড়া পড়ে । কর্মমুখী মানুষের জীবন চাঞ্চল্যে সরব হয়ে ওঠে হাওড় । সমগ্র হাওড়ের মাঝে শুধু একটি মাত্র বটবৃক্ষ যেন সুশীতল ছায়ার আধার । কথিত আছে- এ অঞ্চলে জনবসতির পত্তন হলে হাওড়ের মাঝে গড়ে উঠে একটি ঘর, যা গরু, রাখাল ও কৃষক কুলের বিশ্রাম স্থল, পরবর্তীতে সেটি দোল মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় । প্রায় ধংসপ্রাপ্ত দোল মন্দিরের উপর প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নিয়েছে এক বটবৃক্ষ, বিশাল জলরাশি এবং কখনো উন্মুক্ত সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝে কালের সাক্ষী মন্দিরে জন্ম নেয়া বটবৃক্ষ হাওড়ের অভিভাবক হিসেবে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও ঋতুরাজ বসন্তে অতন্দ্র প্রহরীর মত যেন সদা জাগ্রত, সমস্ত সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে মন্দির ও বটবৃক্ষকে ঘিরে । ২০১২ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল তার জীবন ঢুলী ছবির শুটিং কার্য অনেকটা সম্পন্ন করেন এই মন্দিরকে ঘিরেই ।
মূলত বর্ষা মৌসুমে ডাক বাংলোতে দাঁড়ালে মনে হয় সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে আছি । বিভিন্ন স্থান থেকে ভরা বর্ষায় দর্শনার্থীরা হাওড়ের সৌন্দর্য দেখতে আসেন । সূর্য ডোবার মুহূর্তে সব বয়সের জনসাধারণ ভিড় জমায় হাওড়ের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য । কিন্তু এ হাওড় তীরবর্তী অঞ্চলে এখনো কোন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেনি ।
প্রকৃতপক্ষে সরকারি তত্ত্বাবধানে নাসিরনগর উপজেলার ডাক বাংলো সংলগ্ন মেদিনী হাওড় তীরবর্তী চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে আরো বেশি মানুষ এ হাওড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার জন্য আকৃষ্ট হবে এবং এতে করে সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারবে । পাশাপাশি চিত্ত বিনোদনের প্রাণ কেন্দ্র রূপে এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে । এটি এ অঞ্চলের জনগণেরও দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS