ব্রাহ্মণবাড়িয়ারও যে এককালে উৎকৃষ্ট মসলিন তৈরী হতো একথা আজকের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে চাইবে না । ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ডব্লিউ, ডব্লিউ, হান্টারের "স্যাটেস্টিক্যাল এ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল, ভলিউম-৬"-এ উল্লেখ রয়েছে যে, বিগত শতাব্দীর শেষ পাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে তনজেব নামের অতি উৎকৃষ্ট মসলিন বস্ত্র তৈরী হতো। এ তনজের ঢাকার বিখ্যাত শবনম মসলিনের সমকক্ষ ছিল বলেও উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে। তাছাড়া, আগেই বলা হয়েছে, কালীকচ্ছে উপমহাদেশে প্রথম খদ্দরের কাপড় তৈরী হতো । সেখানে কারখানা ছিল দেশলাই ও ছুরি-কাঁচি তৈরিরও । চলতি শতকের গোড়ার দিকে আখাউড়া, আশুগঞ্জ, চান্দুরায় ইংরেজ ব্যবসায়ীরা জুট বেইলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে "ইর্স্টান বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজিটিয়ার্স টিপারা"-(রচনাকাল ১৯১০ খ্রী:) তে উল্লেখ করা হয়েছে । চান্দুরা এলাকায় উৎপন্ন পাট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোয়ালিটির পাট বলে কথিত এবং তা শুধু কথার কথাই নয়, বৃটিশ আমলে ডান্ডিতে চান্দুরার পাট চান্দুরা পাট পরিচয়ে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছিল । জেলার ব্যবসা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর শহর, আশুগঞ্জ, আখাউড়া, ফান্দাউক, চাতলপাড়, সিঙ্গারবিল, সিমনা বাজার, চান্দুরা, চইয়ারকুড়ি, পানিশ্বর, সাতবর্গ, নবীনগর, আজবপুর, রামচন্দ্রপুর, মানিকনগর, কুটি, বাঞ্ছারামপুর উল্লেখযোগ্য। রামচন্দ্রপুরের লুঙ্গি ও বাঞ্ছারামপুরের তাতেঁর কাপড় বিখ্যাত। তিতাস নদীর পাড়ে পাড়ে রয়েছে অনেকগুলো ইটখোলা । এসব ইটখোলায় গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি কাঠে পোড়ানো ইট স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলেছে ।
সুতাকল : ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তর প্রান্তে মেড্ডা গ্রামে কোকিল টেক্সটাইল মিলস নামে একটি সুতাকল রয়েছে । এতে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে উৎপাদন শুরু হয় । বর্তমানে এই টেক্সটাইল এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ।
বিসিক শিল্প নগরী : ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার নন্দনপুরে একটি বিসিক শিল্প নগরী রয়েছে ।
সাইলো : আশুগঞ্জে একটি খাদ্যশস্য সাইলো রয়েছে । তাছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ৬টি খাদ্য গুদাম ।
কুটির শিল্প : কুটির শিল্পের মধ্যে বাঁশ-বেতের তৈরী পণ্যসামগ্রী, পাটের দড়ি ও শিকা, কাঠের আসবাবপত্র, স্বর্ণালঙ্কার, লৌহজাত দ্রব্য ও মাটির হাড়িঁ-কলস, বাসন-কুসন উল্লেখযোগ্য। তবে এখানে জেলার একমাত্র চরকা ও কুটির শিল্প সংলগ্ন উত্তর প্রান্তের পৌর গ্রাম মেড্ডায় বরিশালের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণকারী গোপালগঞ্জ জেলার দেশহিতৈষী চিরকুমার বিশ্বরঞ্জন সেন কর্তৃক ১৯৭৩ সালের ৩০শে জানুয়ারী স্থাপিত হয় । পশ্চিম জার্মানীর এইড বাংলাদেশ কমিটির এক লাখ ৬০ হাজার টাকা সাহায্যের উপর নির্ভর করে মাত্র ২০ জন সুতা কাটুনী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ আরম্ভ হয় ১৯৭৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। প্রতিষ্ঠাতার নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ওয়ার্ল্ড ডিভিশন, রামকৃষ্ণ মিশন, টেরেডেস হোমস এবং বিসিকসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য-সহযোগিতায় এটা দেশের কুটির শিল্পে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে । এতে ৫২ টি তাঁত, কর্মচারীদের বাড়িতে ৫০টিসহ মোট ৭৫ টি বাশেঁর চরকা, ৬০টি অম্বর চরকা এবং ৬০টি নলী ববিন রয়েছে । রয়েছে কয়েকটি সেলাই মেসিনসহ রং ছাপের ব্যবস্থাও । এসবসহ ডে কেয়ার নার্সারী এবং অন্যান্য মিলিয়ে ২১৯ জন শ্রমিক কর্মচারী রয়েছে এতে । নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গরীব কর্মচারীদের অন্নসংস্থানের মাধ্যম হিসাবে ঢেঁকি ও ইট ভাঙ্গার কাজের ব্যবস্থাও এখানে হয়ে থাকে। ব্যবস্থা রয়েছে কর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদেরকে অক্ষর জ্ঞানদানেরও । এ মহতী প্রতিষ্ঠানটির সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এখানকার কর্মচারীরা এখানেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন । ৩২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত চরকা ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানটিতে মার্কিন কাপড়, লেপ-তোশকের কাপড়, চাদর, বিছানার চাদর, বেড কভার, পর্দার কাপড়, টেবিলক্লথ, তোয়ালে, লুঙ্গি ও গামছা তৈরী হয়ে থাকে এবং এসব কাপড়ের বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরেই । প্রতিষ্ঠানটির কিছু কিছু উন্নত মানের কাপড় দেশের সীমা ছাড়িয়ে নিউজিল্যান্ড ও পশ্চিম জার্মানীর মতো শিল্পোন্নত দেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।
রাধিকার টুপি : এ টুপি শিল্পও উল্লেখযোগ্য প্রশংসার দাবিদার। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে পাঁচ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত সদর থানার রাধিকা নামের গ্রামটি তার বাসিন্দাদের হাতের কাজের পারদর্শিতার গুণে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে । প্রায় ২০০ বছর ধরে এ গাঁয়ের ১০০ এর বেশী পরিবারের অনেকগুলো নিপুন হাত তালের ডায়গা আর জালি বেতের আঁশ দিয়ে টুপি তৈরী করে আসছে । বছরে চার মাস এ কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা । তাছাড়া এ শিল্পকর্ম রাধিকা গ্রামের ক্ষুদ্র গন্ডি অতিক্রম করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার মেড্ডা, ভাদুঘর, জগৎসার, হাবলাউচ্চ ও চানপুর গ্রামগুলোতেও সম্প্রসারিত হচ্ছে ।
তাপ বিদ্যুৎ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত । বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের আয়তন ৩১১ একর । পশ্চিম জার্মানী থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় । ভবনসমূহের নিমার্ণ কাজ শুরু হয় ১৯৬৬ সনের মে মাস থেকে । ১৯৬৮ সনের শেষ দিকে শুরু হয় মূল যন্ত্রপাতিগুলো বসানোর কাজ । প্রথম ইউনিটটি ১৯৭০ এর ২৭শে জুলাই ও দ্বিতীয়টি ১১ই আগস্ট চালু হয় । উভয় ইউনিটের ক্ষমতা ৬৪০০ মেগাওয়াট করে । কেন্দ্রটি স্থাপনের সময়ে এই ইউনিটগুলোর ক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট করে সম্পসারণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল । এছাড়াও দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি অতিরিক্ত ইউনিটে প্রায় ২০০ মেগাওয়াট সম্প্রসারণের ব্যবস্থা ছিল । স্বাধীনতার পরে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যায় দ্রুত হারে । এ চাহিদা মেটানোর জন্যে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্পাসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং প্রতিটি ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটো নতুন ইউনিট বসানোর পরামর্শ দেয় । পরবর্তীকালে ৩য় ও ৪র্থ ইউনিট স্থাপনের জন্যে প্রাপ্ত ঋণের কিছু অর্থ থেকে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড একই ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় । ১৯৮৪ সালের মার্চে ৩য় ও ৪র্থ ইউনিটের কাজ শুরু হয় আর ৫ম টির কাজ শুরু হয় ১৯৮৫এর নভেম্বরে । এই ইউনিট তিনটি যথাক্রমে ১৯৮৬ এর ডিসেম্বর, ৮৭ এর মে এবং ৮৮ এর মার্চে চালু হয় । বর্তমানে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৭২৪ মেগাওয়াট । এখানকার ষ্টীম ও গ্যাস উভয় ধরনের টারবাইনে জ্বালানী হিসেবে তিতাস গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয় ।
আশুগঞ্জ সার কারখানা আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড দেশের চালু সার কারখানাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কারখানা । ইহা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত একটি অত্যাধুনিক সার কারখানা । আশুগঞ্জের সন্নিকটে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার তিতাস গ্যাস হইতে ইউরিয়া সারের প্রধান উপাদান গ্যাসের সহজলভ্যতা এবং সারা দেশের সাথে রেল, সড়ক এবং নদীপথে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা বিবেচনা করে সরকার আশুগঞ্জকে এ কারখানা নির্মাণের স্থান নির্বাচন করে । কারখানাটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ১৯৭৪ সালের অক্টোরব মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার এন্ড কেমিক্যাল কোম্পানী লিমিটেড নামে একটি কোম্পানী গঠন করে । ১৯৮৩ সনের ১লা ডিসেম্বর কারখানাটির পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয় । ১৯৭৬ সালে কারখানার নির্মাণ কাজ শুরু হবার কথা ছিল । কিন্তু মৃত্তিকা জটিলতা এবং আরও কিছু আনুষাঙ্গিক সমস্যার কারণে নির্মাণ কাজ শুরু করতে প্রায় দু’বছর বিলম্ব ঘটে । ১৯৭৮ সালে কারখানার প্রকৃত নিমাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮১ সালে কারখানায় উৎপাদন আরম্ভ হয় । বৃটেনের ফষ্টার হুইলার লিমিটেড কারখানা সাধারণ ঠিকাদার হিসাবে কাজ করে । বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতাল, পশ্চিম জার্মানী, ফ্রান্স, ভারত, অষ্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড ও কানাডাসহ পৃথিবীর বহু দেশ হতে কারখানার মেশিনপত্র এবং নির্মাণ সামগ্রী আনা হয় । নির্মাণকালে প্রায় ২০০ বিদেশী কারিগরসহ দৈনিক প্রায় ৮,০০০(আট হাজার) লোক কাজ করে। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রেও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, কে.এফ.ডব্লিউ (জার্মানী), ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট মিনিষ্ট্রি (ইউ.কে), ইরান, সুইজারল্যান্ড, ইফাদ, ওপেক ও ইইসি প্রকল্পের জন্য ঋণদান করে । ৩৫০.১৮ কোটি টাকা দেশীয় মুদ্রাসহ মোট ৭৫৭.৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানা নির্মাণ করা হয়। উৎপাদন ক্ষমতাঃ কারখানাটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৬০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া এবং ৯৩০ মেট্রিকটন এ্যামোনিয়া । বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,২৮,০০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া ।
পাদুকা শিল্প ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মধ্যপাড়া থেকে পীরবাড়ি এলাকায় জুতা শিল্পের ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে যা এ অঞ্চলের মানুষের পাদুকা চাহিদা মেটানোর পরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয় । এই সব শিল্প কারখানায় এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে অন্য দিকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে । এ সম্ভাবনাময় শিল্পটিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হলে ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিসরে বিস্তার লাভ করবে ।
নৌযান শিল্প (অরুয়াইল পাকশিমূল),আশুগঞ্জ চালের মিল ও লাকড়ি, লিচু ও অন্যান্য ফলমূল, অর্কিড রপ্তানী (সরাইল) |
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস